আপনার পাশের বাড়ির রিমার হার না মানা লড়াই, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে

2291
আপনার পাশের বাড়ির রিমাদির হার না মানা লড়াই, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে
আপনার পাশের বাড়ির রিমাদির হার না মানা লড়াই, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে

আপনার পাশের বাড়ির রিমাদির হার না মানা লড়াই; সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। কিছু ঘটনা তেমন ভাবে প্রচার পায় না, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় না। কারণ তারা যে আপনার আমার পাশের বাড়ির মেয়ে। বাড়ির পাশের মেয়ে শ্রদ্ধা সম্ভ্রম নাম পাবার মত কিছু করলে, তাকে স্বীকৃতি দিতে কেমন একটা বাধে। তবে আজও তো; ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ আমাদের কাছে।

দমদম জয়পুর রোডের বাসিন্দা, বছর বিয়াল্লিশের গৃহবধূ রিমা নন্দী দত্ত। আর পাঁচটা বাঙালী মধ্যবিত্ত বাড়ির গৃহবধূ যেমন হয় আরকি। স্বামী সংসার মেয়ে নিয়ে মধ্যবিত্ত জীবন যাপন। ঠিক আমার আপনার মতোই। হঠাৎই সেই রিমার জীবনে নেমে এল, মর্মান্তিক বিপর্যয়। ২০২১ এর মার্চে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন রিমা; সেরেও যান। তারপরেই ২১ এর এপ্রিলে, কোভিড ধরা পড়লে; স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন রিমা। করোনা সারিয়ে বাড়িও ফেরেন তিনি। বাড়ি ফেরার দিন দুয়েক পর থেকেই; তাঁর পা ফুলতে শুরু করে। সঙ্গে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা। স্ত্রীর দুই পায়ে রক্তের ছোপ পড়তে দেখে; চমকে যান স্বামী বিশ্বরূপ দত্ত।

কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শেষে এক চিকিৎসকের পরামর্শে, মে মাসে পিজিতে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দুদিনের মাথায় ফের করোনা ধরা পড়ায়; শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে পাঠানো হয় রিমাকে। এদিকে করোনা সারলেও, করোনা পরবর্তী সিম্পটম হিসেবে; রিমার দুটি পায়ের ধমনী ও শিরায় রক্ত জমাট বাঁধছিল। ১০ দিন পরে করোনা নেগেটিভ হয়ে ফের পিজিতে ফিরলেও; দেখা যায় তাঁর দুটি পা পুরো কালো। শল্য বিভাগে পরীক্ষায় দেখা যায়; পায়ে পচন ধরেছে। করোনার সাইটোকাইন সাইড এফেক্টের কারণে; শিরা ও ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধছে; বিরল এক রোগ।

বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক ও শল্যচিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি। অবশ্য তাঁদের কিছুই করার ছিলও না। করোনা-পরবর্তী সমস্যা হিসেবে রিমার দুটি পায়ের ধমনি ও শিরায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল। তাতেই বিপত্তি হয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে রিমার দুটি পা, কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া; অন্য কোন উপায় ছিল না ডাক্তারদের কাছে।

শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়; “প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান ছিল। অবিলম্বে পা বাদ না দিলে; প্রাণ সংশয় হতে পারে বুঝে অস্ত্রোপচার করি। এমন বড় ভাবে ধমনী ও শিরাতে রক্ত জমাট বাঁধা বিরল; পোস্ট-কোভিডে দুটি পা একসঙ্গে বাদ দেওয়ার ঘটনাও বিশ্বে বিরল”।

প্রাণে বাঁচলেও, দুটি পা বাদ যাওয়ার ধাক্কা ছিল সাংঘাতিক; শারীরিকভাবে তো বটেই; মানসিক শক্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল রিমার। গত বছরের জুনের প্রথমে, অস্ত্রোপচারের পরের দিন আচ্ছন্ন ভাব কাটতেই; চাদর সরিয়ে নিজের অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন রিমা। চোখের সামনে নেমে এসেছিল একরাশ অন্ধকার; চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন রিমা। দাদা শঙ্কর নন্দী বোনের গালে চড় মেরে বলেছিলেন; “তোকে বাঁচতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে”। কিন্তু বোন যে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তা তখন ভাবেননি দাদা।

পিজির শল্য বিভাগে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই; পিজির ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমআর) বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। দুটি পা হারানোর পরেও; রিমা কিন্ত হার মানেননি। হার মানেননি পিজির শল্য চিকিৎসকরা। রোগীকে পা ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল, চিকিৎসকদের একমাত্র লক্ষ্য। রিমা একটু সুস্থ হতেই, শুরু হয়; বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। ধীরে ধীরে নিজে থেকে উঠে বসা, হুইলচেয়ারে ওঠার মতো বিভিন্ন কাজে আবার সাবলম্বী হতেই; অস্থায়ী কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেখা হয়, তিনি কতটা নিতে পারছেন। দেশীয় কৃত্রিম পায়ের ওজন অনেকটা বেশি; তাই বিদেশি প্রযুক্তির পা, যেটির ওজন কম এবং কার্যকারিতা অনেক বেশি; সেটি লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়। সরকারি হাসপাতালে প্রায় বিনামূল্যে; এই কাজ করা হয়।

দীর্ঘ চিকিৎসার পর জার্মানি থেকে কৃত্রিম পা এনে লাগানো হয়; কলকাতার গৃহবধূর দুই হাঁটুর নিচে। বহু প্রশিক্ষণের পর নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ান রিমা। যে হাসপাতালে তার দুই পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল; সেই হাসপাতালেই আবার ‘নিজের পায়ে’ দাঁড়ালেন রিমা নন্দী দত্ত।

দীর্ঘ চিকিৎসার পর জার্মানি থেকে ভারত সরকারের খরচে নিয়ে আসা; কৃত্রিম পা লাগানো হয় রিমার দুই হাঁটুর নিচে। রাজ্য স্বাস্থ্য ভবনের উদ্যোগ ছিল দেখার মত। তবে কৃত্রিম পা লাগালেই হল না; অসহ্য কষ্ট যন্ত্রণা উপেক্ষা করে; নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা অসম্ভব কঠিন এক কাজ। তবে তাতেও দমেননি রিমা। কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হাঁটাচলার প্রশিক্ষণের মধ্যেই তিনি বলেন; “হোক না কৃত্রিম পা। আমি আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, হাঁটছি। ইচ্ছে করছে, মেয়ের কাছে ছুটে যাই”।

রিমার চোখেমুখে ছিটকে পড়া আশার আলো দেখে; পরিজন থেকে চিকিৎসক, সবাই বলছেন, “এই দিনটারই তো অপেক্ষা ছিল”। সূত্রের খবর, খরচ হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। কিন্তু নিজের পা ফিরে পাওয়ার কাছে; সেটা কিছুই নয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আর কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ শেষে; কোন অবলম্বন ছাড়াই হাঁটবেন রিমা। বৃদ্ধা শাশুড়ি, সাত বছরের মেয়ে, দেওরকে নিয়ে সংসার রিমার। সেই সংসারে আবার খুশির ছোঁয়া, ফেরত এসেছে হাসি। রিমার জীবন যুদ্ধে যেন পরতে পরতে লেখা,‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’।

মনের জোর, অব্যক্ত যন্ত্রণা সহ্য করার, মানসিক অস্থিরতা জয় করার অসীম ক্ষমতা দিয়েই; রিমা জিতেছেন। বিয়াল্লিশ বছরের গৃহবধূ হেসেছেন শেষ হাসি; নিয়তির কাছে সমর্পণ করেননি নিজেকে।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন