‘মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’, সুধার চিঠিতে পিছু হঠেছিলেন টাটা

1972
‘মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’, সুধার চিঠিতে পিছু হঠেছিলেন টাটা
‘মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’, সুধার চিঠিতে পিছু হঠেছিলেন টাটা

‘মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’; টাটার টেলকো-র চাকরির বিজ্ঞাপনের নীচে লেখা ছিল এই কথাগুলো। দেখে আরও রোখ চেপে গেল; এক ভদ্রমহিলার। ঠিক করলেন, এই চাকরিই করতে হবে; আবেদন তো করলেনই, সেই সঙ্গে ‘টাটার বস’ স্বয়ং জে আর ডি টাটাকেই চিঠি লিখলেন। চাকরিতে আবেদন করার আগেই, কোম্পানির বসকে চিঠি; জানতে চাইলেন “চাকরির ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ কী”?

নিরাশ হতে হল না ভদ্রমহিলাকে; সত্বর এল উত্তর। ‘বিশেষ ইন্টারভিউ’-এর বন্দোবস্ত করা হল; শুধু তাঁর জন্য। চাকরির জন্য মনোনীত হলেন তিনি; প্রথম মহিলা ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যোগ দিলেন ‘টেলকো’-তে। টাটার প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার; নাম সুধা কুলকার্নি যিনি পরবর্তী-কালে বিখ্যাত হন সুধা মূর্তি নামে।

সুধা মূর্তি, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায়; নারীদের প্রতি দৃষ্টি পরিবর্তনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি প্রথমে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে তাঁর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন; কর্ণাটকের KLE টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন, কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর; ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের থেকে। তিনি তার শ্রেনীতে প্রথম হন এবং দিল্লী-র ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তরফ থেকে; গোল্ড মেডেল লাভ করেন।

ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ; সুধা ছিলেন স্বর্ণপদকজয়ী। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সে এমই করেন; ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স থেকে; সেখানেও তিনি প্রথম। স্বর্ণপদক পেলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে; ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়েও তাঁর ব্যাচে সুধা একাই ছিলেন ছাত্রী; বাকি সব পড়ুয়াই ছাত্র।

ক্লাসে ৫৯৯টা ছেলে আর একটিই মেয়ে; সুধা কুলকার্নি। সে আমলে মেয়েরা তেমন কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত না যে; সুধা জোর করে ভর্তি হয়েছিলেন। কর্ণাটকের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে; সে শহরের প্রথম ছাত্রী। কলেজের প্রিন্সিপাল সুধাকে ডেকে বলেছিলেন; তিনটি শর্ত অবশ্যই মানতে হবে।
১) রোজ শাড়ি পরে আসতে হবে ।
২) কলেজ ক্যান্টিনে ছেলেদের ভিড়, ওদিকে যাওয়া চলবে না।
৩) কোন ছেলের সঙ্গে ক্লাসে কথা বলা যাবে না।

তিনি অক্ষরে অক্ষরে তিনটিই মেনে চলতেন। কিন্তু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে, তিননম্বর শর্তটি আর মানা সম্ভব হয়নি; কারণ ছেলেরা তাঁর দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে ফিরল এবং এসে কথা বলল। এটা নিশ্চয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে; ওই ৬০০ স্টুডেন্টের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছিলেন সুধাই। জীবনে কোন পরীক্ষায়, তিনি দ্বিতীয় হননি।

পেশাদারী জীবন শুরু করেন; একজন কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। তিনিই প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার; যাকে ভারতের বৃহত্তম অটো ম্যানুফ্যাকচর কোম্পানি টাটা টেলকো-তে (TELCO) ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নি্যুক্ত করা হয়েছিল। প্রথমে তিনি ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পুনেতে নিযুক্ত হন; এবং পরে তিনি যথাক্রমে মুম্বাইতে এবং জামশেদপুরেও কাজ করেছেন।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরোনোর পরই; সুধা দেখালেন অদ্ভুত ব্যাপার। তাঁর জন্য কোথাও কোন চাকরির দরজা খোলা নেই। সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিই; মেল ডমিনেটিং। মহিলা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য দরজা বন্ধ। বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে সুধা কুলকার্নির; ইঞ্জিনিয়ার চাই, যোগ্যতা অমুক তমুক। কিন্তু নিচে বড় হরফে লেখা; ‘মহিলাদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই’। কি আশ্চর্য! তাই না? খুব বেশিদিন আগেও না। ১৯৭০-৭২ সময়ের ঘটনা। তাই সুধা লড়াই শুরু করলেন; ভারতের এক নম্বর কোম্পানির বিরুদ্ধেই।

টেলকোতেই, ‘চাকরি শুধুমাত্র পুরুষদের’ এই শর্তের বিরুদ্ধে; লিঙ্গ-বৈষম্যের অভিযোগে তিনি সরাসরি কোম্পানির চেয়ারম্যান জেআরডি টাটাকে চিঠি লিখেছিলেন। তরুণী সুধার যুক্তি মেনে নেন; ভারতের কিংবদন্তি শিল্পপতি জেআরডি টাটা। তারপরেই ইতিহাস ‘বিশেষ ইন্টারভিউ’র বন্দোবস্ত করা হল সুধার জন্য; চাকরির জন্য মনোনীত হলেন তিনি। ভারতের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে; যোগ দিলেন টাটা ‘টেলকো’তে।

হ্যাঁ, ভারতের বৃহত্তম অটোমোবাইল কারখানা Tata Engineering and Locomotive Company বা টেলকো-তে; প্রথম নারী-কর্মী ছিলেন সুধা মুর্তি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে, নারী তার স্বাধীনতা ও স্বীকৃতি হারাচ্ছে; নিজের যোগ্যতা-গুলোকে কাজে লাগাতে পারছে না। এটাই মেনে নেননি সুধা। তার জন্য তাঁকে অনেক বাধা-বিপত্তি; অতিক্রম করতে হয়েছে। তবে কাউকে না কাউকে তো, প্রথমে এই অসম লড়াইটা চালাতে হয়; তার সুফল ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্ম।

Comments

comments

আপনাদের মতামত জানাতে কমেন্ট করুন